
সম্ভবত ২০১৮ সালের প্রথম দিকের কথা। ফেব্রুয়ারি কিংবা মার্চ মাসের কোন একটা দিন। আমি তখন সরকারি ডরমেটরিতে থাকি। মাস্টার্সের থিসিস লেখা শুরু করেছি। প্রতিদিন সকালে উঠে নাস্তা করে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে গাজি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পাঠাগারের উদ্দেশ্যে রওনা দিতাম। প্রায় রাত ৯ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত থাকা হতাে। ডরমেটরি থেকে পাঠাগারের দূরত্ব হাঁটা পথে ৩০ মিনিট। প্রায় সময় হেঁটেই ফিরতাম।
প্রতিদিন পাঠাগারে আসা-যাওয়ার ফাঁকে আমার একটা বন্ধু জুটে গেল, নাম এলমাস। আমার চেয়ে বয়সে ছােট হলে ও, প্রায় আমাকে শাসনে রাখতাে খাবার দাবার আর পড়াশােনা নিয়ে। ও মাস্টার্সের থিসিসের কাজে নিয়মিত পাঠাগারে আসে। একদিন দুজনের শখ হল পাঠাগারেই রাত যাপন করবাে। সেই অনুযায়ী আমি ডরমেটরি থেকে অনুমতি নিলাম। ও বাবা-মার সাথে থাকে তাই এইসব আনুষ্ঠানিকতা করতে হয়নি। কিন্তু রাত যখন একটু বাড়তে লাগলাে আমাদের ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করা শুরু হল। তখন এলমাস বললাে, মােবাশ্বেরা ব্যাগ গােছাও। এখন তাে তােমার ডরমেটরিতে ফেরার উপায় নাই। আজ রাতে তাই আমাদের বাসায় চলাে। সকালে একসাথে পাঠাগারে ফিরবাে। আমি ওর ভরসাতে রাতে পাঠাগারে থাকার নিয়ত করলাম, এখন সে যখন নিয়ত বদলে ফেলেছে তখন উপায়ান্তর না দেখেই ওকে অনুসরণ করলাম। রাত ১২ টা বাজতে কিছু বাকি এমন সময় আমরা পাঠাগার থেকে বের হয়ে মূল রাস্তায় এলাম। শীতের রাত। কুকুর আর প্রহরীছাড়া পথচারী নেই বললেই চলে। দোকানপাট সব বন্ধ। এলমাসের বাসায় যাওয়ার বাসটা ও শেষ যাত্রীদের নিয়ে বহু আগে রওনা দিয়েছে। অগত্যা ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম দু’জনে। আমি কিছুটা বিভ্রান্ত! কারন এখন যা হচ্ছে তার কোনটা ই পূর্বপরিকল্পিত নয়। এতাে রাতে ওদের বাসার মানুষজনই বা কি ভাববে! মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। যাই হােক ৩০ থেকে ৪০ মিনিটের মাথায় আমরা এলমাসদের বাসায় পৌঁছে গেলাম। ওর মা হাসি মুখে দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানালাে আমাকে। অথচ, আমি ভেবেছিলাম, এতাে রাতে ঘুম ঘুম বিরক্ত একটা চেহারা দেখতে পাবাে।
হাতমুখ ধুয়েই আমরা খাবার টেবিলে চলে গেলাম। শীতের রাতে ক্ষুধার্ত পেটে ঐ চর্বাকে (সূপ) অমৃত মনে হচ্ছিল। এরপর বিখ্যাত টার্কিশ চা খেলাম। সাথে নানা বাদাম আর লােকম (একপ্রকার মিষ্টি) দিলাে। কথা প্রসঙ্গে এলমাস ওর মাকে জানালাে আমি বিবাহিত। এই কথা শুনে ওর মা তাে আকাশ থেকে পড়েছে! কতাে প্রশ্ন যে করলেন আমার জামাই আর বিয়ে নিয়ে? এরপর আমার বিয়ের ছবি দেখালাম, ছবি দেখে খালাম্মা বলে উঠলেন পুরােই তাে ভারতীয় সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের মতােন লাগছে। এলমাস পাশ থেকে বলে উঠলাে, “মােবাশ্বেরা আর ওর জামাই প্রায়ই টিভিতে সাক্ষাতকার, লাইভ দেয়। ওরা সিরিয়ালেও অভিনয় করে বলে মুখ টিপে টিপে হাসছে।” আমি একবার এলমাসের মাকে দেখছি একবার এলমাসকে দেখছি। খালাম্মা প্রায় বিশ্বাস করার দশা! তখন আমি এলমাসকে বলে উঠলাম, আর মনে হয় এগােনাে উচিত হবেনা। পরে তাে তিনজন মিলে প্রচুর হাসলাম। এখনাে সেই রাতের কথা মনে পড়লে হাসি পায় । এলমাসের মা চ্যানেল ৭ এ ভারতীয় সিরিয়াল দেখেন। আমার বিয়ের পােশাক ও শাড়ি হওয়াতে ওনাকে এলমাস একটু বােকা বানাতে চেয়েছিল।
গল্পেসল্পে রাত প্রায় দু’টো বেজে গেলাে। আমাদের রাত জেগে পড়াশােনা ও লাটে উঠলাে। এরপর সে যা করলাে তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। এমনকি বেশ বিব্রতবােধ করছি। একে তাে রাত বিরাতে মানুষের বাসায় এলাম, তার উপর শীতের রাত। সব মিলিয়ে বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। সে তার সুন্দর ও আরামের বিছানাটা আমার জন্য। ছেড়ে দিয়ে নিচে বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাে। এলমাস বারবার বলছিলাে, “আজ রাতে তুমি মুসাফির। তাই তােমার সুবিধাটাকে আগ্রাধিকার দিবাে। আমি জানি তােমার ঠান্ডার সমস্যা আছে।”এরপর কিছুটা ক্লান্তিতে কিছুটা আরামে কখন ঘুমে তলিয়ে গেছি টের পাইনি।

সকালে সবাই মিলে নাস্তা করলাম। এলমাসের বাবা আর ছােট ভাইয়ের সাথেও পরিচয় হল। নাস্তার টেবিলে খালাম্মা আমার জন্য নানান রকমের জেলির বয়াম খুলে রেখেছেন। আমি অল্পহারী মানুষ। এতাে আয়ােজন। দেখেই পেট ভরে গেছে। খাবাে আর কি? বিদায় নিয়ে বের হওয়ার আগে খালাম্মা আমার জন্য দুইটা উপহারের প্যাকেট নিয়ে হাজির। আমার তাে চোখ কপালে! করেছে কি ভদ্রমহিলা? আমি বারবার করে বলছিলাম, ‘এমনিতেই খবর ছাড়া রাত বিরাতে মুসাফির হলাম। তার উপর আবার উপহার! এইটা আমি নিতে পারিনা।’ উনি তখন উত্তর দিলেন, “শােন! মােবাশ্বেরা, আমি তােমার গল্প অনেক শুনেছি এলমাসের কাছে। পরিচিত হয়ে খুব খুশি হয়েছি। তােমার পরিবার ও দেশ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এইগুলাে আমার জন্য খুব মূল্যবান। ও তােমাকে রাতে একা রেখে বাসায় এলেই বরং আমি রাগ করতাম। তাছাড়া মুসাফিরকে উপহার দেওয়া আমাদের ঐতিহ্যের অংশ এবং উপহার কখনাে ফিরিয়ে দিতে নেই। “এরপর আমার খালাম্মাকে ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় ছিলনা। শুধু বললাম, ‘অনেক কষ্ট দিলাম। সবকিছুর জন্যই ধন্যবাদ। আপনাদের সাথে পরিচিত হতে পেরে আমার ও ভালাে লাগলাে।’
প্রায় দু’বছর হতে চললাে খালাম্মাকে আর এলমাসকে দেখি না। কিন্তু তাদের আন্তরিকতা, আতিথেয়তা কখনাে ভােলার নয়। এখনাে ফোনে যােগাযােগ হয় আমাদের। চাকরি, পড়াশােনা মিলিয়ে একদম সময়। করে উঠতে পারিনি। এলমাস প্রায় অভিযােগ করে ওর বাসায় যাইনা বলে। খালাম্মা এখনাে আমার কুশল জানতে চান। তুরস্কের সবাই বিদেশিদের অপছন্দ করেনা। কেউ কেউ অজান্তেই আপনাকে আপন করে নিবে। এ এক অদ্ভুত বন্ধন!
লেখিকা: মােবাশ্বেরা জাহান ফাতিমা। পিএইচডি শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা বিভাগ, আনকারা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষক, মাইগ্রেশন স্টাডিজ ফাউন্ডেশন, আনকারা, তুরস্ক।
লেখাটি অ্যাবাস্টের ম্যাগাজিন ‘আনাতোলিয়া’ প্রথম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। অ্যাবাস্টের ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যার সবগুলো লেখা পড়তে ক্লিক করুন এখানে।