Transliteration – Review of Rise of Empires: Ottoman

Transliteration - Review of Empires Ottoman Post Cover

এ বছরের একদম শুরুতে জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখে নেটফ্লিক্স অটোমান সাম্রাজ্যের ছোট্ট বিজয়, বাইজেন্টিয়ামের দুর্দান্ত প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত একটি ডকুড্রামা প্রকাশ করেছে।

তবে নেটফ্লিক্সের এই ডকুমেন্টারি সিরিজ, অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান বা ইস্তাম্বুলের বিজয় সম্পর্কে নয়, বরং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুর্দান্ত প্রতিরক্ষা ও পতনের ভুল ঐতিহাসিক বিবরণ।

“Rise of Empires” শিরোনামের অধীনে অত্যধিক প্রত্যাশিত এই ডকুমেন্টারি সিরিজটির প্রথম সিজন রচনা ও পরিচালনা করেছেন এমরে শাহিন। এখানে ইস্তাম্বুলের বিজয়কে চিত্রিত করা হয়েছে, যা অটোমান রাষ্ট্রের সাম্রাজ্যে রূপান্তর এবং দ্বিতীয় সুলতান মেহমেদ, বিজয়ী আকা মেহমেদের জীবনকে ইঙ্গিত করে।

সিরিজটি শুরু হয় ওসমান গাজীর “কনস্ট্যান্টিনোপলের স্বপ্ন” (১২৮০) এর একটি সংক্ষিপ্তসার দিয়ে, যা মূলত একটি রূপক গাছ নিয়ে তাঁর একটি পূর্বসূতী স্বপ্ন। তাঁর এই স্বপ্ন নিয়ে বলার আগে আমাদের জেনে নেওয়া দরকার ওসমান গাজী আসলে কে ছিলেন? ‘ওসমানের স্বপ্ন’ বলতে কি বোঝানো হয়েছে? অটোমান সম্রাজ্যে তাঁর ভূমিকাই বা কি?

প্রথম ওসমান বা ওসমান গাজী, তুর্কি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘অটোমান’, তিনি ছিলেন তুর্কিদের নেতা এবং অটোমান রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর নাম প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে কখনও কখনও ‘Othman’ হিসাবেও লিপিবদ্ধ হয়েছিল। তাঁর এই নাম বহনকারী রাজবংশ পরবর্তীকালে অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও শাসন করে।

আর ‘ওসমানের স্বপ্ন’ মূলত অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম ওসমানের জীবন নিয়ে একটি পৌরাণিক কাহিনী। পৌরাণিক কাহিনী কারণ, ওসমান গাজীর শাসনামল সম্পর্কে খুব কমই জানা গিয়েছে। তাঁর মৃত্যুর প্রায় এক শতাব্দী পর ঐতিহাসিকেরা তার জীবনী রচনায় হাত দিয়েছিলেন। তাই ওসমান গাজীর জীবন সম্পর্কে প্রচলিত কথাগুলোর কোনটা বাস্তব আর কোনটা কাল্পনিক, সেগুলোর মাঝে পার্থক্য করা ঐতিহাসিকদের জন্য বেশ কঠিনই বটে। প্রচলিত গল্পটিতে ওসমানের একটি স্বপ্নের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে যা একটি ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শেখ এদেবালির বাড়িতে থাকাকালীন হয়েছিল, যেখানে তিনি একটি রূপক দৃষ্টিভঙ্গি দেখেছিলেন যে, তাঁর বংশধর ও তাঁর দ্বারা একটি সাম্রাজ্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধি শাসিত হবে। এই গল্পটি পঞ্চদশ শতাব্দীতে ওসমানের মৃত্যুর একশো বছরেরও বেশি সময় পরে আবির্ভূত হয়েছিল এবং ধারণা করা হয় যে, এই সাম্রাজ্যের ভিত্তি পুরাণের পাশাপাশি ওসমানের জীবনকে শোভিত করার এবং তার পরবর্তী সাফল্যের ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্যই নির্মিত হয়েছিল। অটোমান লেখকরা তাদের সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার এই কথিত স্বপ্নকে খুব গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এবার ‘ওসমানের স্বপ্ন’ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক।

ওসমানের স্বপ্ন

অল্প বয়স থেকেই ওসমান সবার কাছে ধর্মভীরু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একসময় তিনি শেখ এদেবালি নামক এক ধর্মগুরুর ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হয়ে নিয়মিত তার সাথে দেখা করতে যেতেন। এস্কিসেহির শহরের এক গ্রাম ইতবার্নুতে এদেবালির সাথে দেখা করতে যেতেন ওসমান। একদিন এদেবালির সাথে দেখা করতে গিয়ে তার মেয়ে মাল হাতুনের সাথে ঘটনাক্রমে তাঁর দেখা হয়ে যায়। মাল হাতুনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ওসমান তাকে ভালোবেসে ফেলেন। ফলে এদেবালির বাড়িতে তার যাওয়া-আসার মাত্রাও বেড়ে যায়। একসময় তিনি এদেবালিকে তার মনের কথা খুলে বলেন। কিন্তু ওসমানের সাথে নিজের সামাজিক পদমর্যাদা কাছাকাছি না হওয়ায় এ বিয়েতে রাজি হন নি এদেবালি।

এমন প্রত্যাখ্যান সহজে মেনে নিতে পারেন নি তরুণ ওসমান গাজী। তাই প্রায়ই বন্ধুদের কাছে নিজের হতাশা ব্যক্ত করতেন তিনি। সমস্যা হলো – তার কাছে মাল হাতুনের রুপের বর্ণনা শুনতে শুনতে তার বন্ধুদের মাঝেও মেয়েটির প্রতি আকর্ষণ জন্মাতে শুরু করে। এদের মধ্যেই একজন ছিলেন এস্কিসেহিরের এক তরুণ নেতা। তিনিও এদেবালির কাছে মাল হাতুনকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তার ভাগ্যেও ওসমানের মতো প্রত্যাখ্যান জোটে। কিন্তু একজন নেতাকে এভাবে ফিরিয়ে দিয়ে এদেবালি কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়ে নিজের বাসা পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

ওদিকে এস্কিসেহিরের সেই নেতার মনে আস্তে আস্তে ওসমান সম্পর্কে বিরুপ মনোভাব জন্মাতে শুরু করে। একসময় তিনি তাকে প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখা শুরু করে দেন। একদিন ওসমান তার ভাই গোকাল্পকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী ইনয়ানীর জমিদারের দুর্গে ঘুরতে গিয়েছিলেন। তখনই সেই নেতা তার আরেক বন্ধু মাইকেলকে নিয়ে সেই দুর্গ ঘেরাও করে বসেন এবং জমিদারকে বলেন ওসমানকে তার হাতে তুলে দিতে। কিন্তু অতিথির এমন অমর্যাদা করতে রাজি হচ্ছিলেন না সেই জমিদার। তাই শত্রুরা দুর্গের বাইরে অবরোধ করে বসে। পরবর্তীতে ওসমান ও তার ভাইয়ের বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে তাদের সেই প্রতিরোধ ভেঙে যায়। তরুণ নেতা কোনোমতে জান নিয়ে পালাতে সক্ষম হলেও ধরা পড়ে যান মাইকেল। পরবর্তীতে অবশ্য এ মাইকেলের সাথেই ওসমানের চমৎকার বন্ধুত্ব হয়েছিলো।

এভাবে যুদ্ধ জয়ের ফলে ওসমান একজন বন্ধু পেলেন ঠিকই, কিন্তু মনের মানুষটি তখনো ছিলো তার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এভাবেই কেটে যায় দুটি বছর। দুশ্চিন্তায় ওসমানের স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটে।

এতকিছুর পরেও এদেবালির সাথে ওসমানের যোগাযোগ ঠিকই ছিলো। এক রাতের কথা। এদেবালির বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ওসমান গাজী। মাল হাতুনকে নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। ঘুমের মাঝেই তিনি এমন এক স্বপ্ন দেখেন ইতিহাসে বেশ বিখ্যাত হয়ে আছে।

“ওসমান এবং এদেবালি এক জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই এদেবালির বুকের ভেতর থেকে একটি পূর্ণ চাঁদ বের হয়ে তা আবার ধীরে ধীরে ওসমানের বুকের ভেতর হারিয়ে যায়।

এরপরই বেশ চমৎকার একটি গাছ ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করে। তার যেন আর থামার নাম নেই, বড় হচ্ছে তো হচ্ছেই। এভাবে গাছটির শাখা-প্রশাখা, ছায়া পৃথিবীর দিগন্তের প্রায় তিন ভাগকে ঢেকে ফেলার আগপর্যন্ত বড় হতেই থাকে। এ গাছের নিচে ছিলো চারটি পাহাড় – ককেশাস, অ্যাটলাস, টোরাস ও হীমাস। দেখে মনে হচ্ছিলো যে, এ পাহাড়গুলোর উপর ঠেস দিয়েই দাঁড়িয়ে আছে সুবিশাল সেই গাছ। গাছটির গোড়া থেকে বেরিয়ে এসেছিলো টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস, দানিয়ুব ও নীল নদ। বড়-ছোট পাল তোলা অনেক জাহাজই ঘুরে বেড়াচ্ছিলো সেসব জায়গায়।

মাঠগুলো ভরে গিয়েছিলো খাদ্যশস্যে, পাহাড়গুলোর আশেপাশেও ছিলো বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল। পাহাড়গুলোর মধ্যবর্তী এলাকা জুড়ে ছিলো জাঁকজমকপূর্ণ শহরের উপস্থিতি। অজস্র গম্বুজ, পিরামিড, ওবেলিস্ক, মসজিদের মিনার আর সুউচ্চ টাওয়ার জানান দিচ্ছিলো সেই শহরটির আভিজাত্যের মাত্রা। তাদের শীর্ষভাগে শোভা পাচ্ছিলো এক অর্ধচন্দ্র। দূর থেকে ভেসে আসছিলো মুয়াজ্জিনের আজানের সুমধুর ধ্বনি। হাজার হাজার নাইটিঙ্গেলের মনমাতানো ডাকের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো সেই আজানের সুর।

মিষ্টি কন্ঠের অসংখ্য পাখির সমাবেশ ঘটেছিলো সেখানে। তাদের কিচিরমিচির ডাক যেন মাতাল করে ছাড়ছিলো গাছটিকেও। গাছটির প্রতিটি পাতাই ছিলো তুর্কীদের পুরনো আমলের খঞ্জরের মতো দেখতে। হঠাৎ করেই বাতাসের বেগ যেন বেড়ে গেলো। আর সেই সাথে পাতাগুলোর তীক্ষ্ম দিকগুলোও বিশ্বের নানা শহরের দিকে মুখ করে ঘুরে গেলো। তবে সেগুলো বিশেষভাবে কনস্টান্টিনোপলের দিকে মুখ করে ঘুরে ছিলো। দুটো সাগর ও দুটো মহাদেশের মিলনস্থলে অবস্থিত সেই শহরটিকে দুটো স্যাফায়ার ও দুটো এমারেল্ডের মাঝে বসানো একটি ডায়মন্ডের মতো লাগছিলো। এর ফলে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান পাথরই যেন হয়ে উঠেছিলো সেটি। ওসমান গাজী যখন সেই দৃষ্টিনন্দন পাথর বসানো আংটি নিজের আঙুলে ঢোকাতে যাচ্ছিলেন, তখনই তার ঘুম ভেঙে যায়।”

ঘুম থেকে উঠে ওসমান এদেবালিকে তার স্বপ্নের কথা জানালেন। এদেবালি বুঝলেন যে, এটি কোনো সাধারণ স্বপ্ন নয়। বরং এর মাঝেই লুকিয়ে আছে ওসমান ও তার মেয়ে মাল হাতুনের এক হওয়া থেকে শুরু করে ওসমানের ভবিষ্যতে অনেক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির মালিক হওয়ার ইঙ্গিত। এরপর তাই আর আপত্তি করলেন না তিনি। নিজের পছন্দের শিষ্য দরবেশ তোরুদকে ডেকে এনে ওসমান আর মাল হাতুনের বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করেন তিনি।

এবার আসা যাক আসল কথায়। এতক্ষণ ধরে ওসমানের এত বড় স্বপ্নের কথা পড়ে অনেকেরই অবিশ্বাসে ভ্রু কুঁচকে গেছে নিশ্চিত। এটাই স্বাভাবিক। কারণ ওসমানের বিখ্যাত এ স্বপ্নের কথা কিন্তু লেখা হয়েছিলো তার মৃত্যুর একশ বছরেরও বেশি সময় পরে। তাই ধারণা করা হয় যে, এ স্বপ্নের কথা আসলে কোনো উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না। অটোমান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের ইতিহাসকে আরো মহিমাময় করে তুলতে এবং সেই সাথে ওসমান গাজীর অর্জন ও সাফল্যকে আরো চমৎকারভাবে সবার কাছে তুলে ধরতেই এ কল্পনার আশ্রয় নেয়া হয়েছিলো। অবশ্য অটোমান ঐতিহাসিকেরা সব সময়ই তাদের সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের এ ইতিহাসটিকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সবার সামনে তুলে ধরতেন।

তবে এটা সত্য যে, শেখ এদেবালি নামে আসলেই এক ব্যক্তি ছিলেন যার সাথে ওসমানের খাতিরের সূত্র ধরেই তার মেয়ে মাল হাতুনের সাথে ওসমানের বিয়ে হয়। তবে মাইকেল ও দরবেশ তোরুদের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে কিছু কিছু ইতিহাসবিদের। মূলত এই স্বপ্নই কনস্ট্যান্টিনোপলের বিজয়কে ইঙ্গিত করে যা দ্বারা সিরিজটির ১ম পর্বের সূচনা হয়।

সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের দৃশ্যের পরে, সিটি ওয়ালের দিকে নজর রাখা সুলতান মেহমেদের কাছ থেকে এই বাক্যটি শোনা যায়, “Constantinople … Either I conquer you or you conquer me”. এরই মধ্যে সম্রাট কনস্টানটাইন প্রতিরক্ষা প্রাচীরে হাজির হন। তার সাথে দ্বিতীয় মেহমেদের এক দফা চোখাচোখি হওয়ার সময় সুলতানের পিতা মুরাদ তাঁর সামনে উপস্থিত হয়। যেই মুহূর্তে কনস্টানটাইন তাঁর তলোয়ার নিয়ে মুরাদের পেছনে তাকে হত্যা করার জন্য আসে, ঠিক সেই মুহুর্তে মেহমেদ জেগে ওঠে। এই উদ্বোধনী দৃশ্যের মাধ্যমে স্বপ্নটিতে সুলতান মেহমেদের চোখ দিয়ে একটি মনস্তত্ত্বের আভাস পাওয়া যায় যা বিজয়ের সবচেয়ে হিংসাত্মক এবং চরম দুর্দশাপূর্ণ মুহুর্তগুলিকে প্রাধান্য দেয়। এবং যখন সে তার তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসে, সে দেখতে পায় দেয়ালগুলো পুড়ছে, গুলিবর্ষণ চলছে এবং সৈন্যরা যুদ্ধ করছে।

সিরিজে ফিচার করা দুটি স্বপ্নই বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। সুলতান ওসমান ছিলেন একজন আদর্শবাদী সুলতান। অটোমান রাজবংশ এই আদর্শগুলিকে “দ্যা রেড অ্যাপল” দ্বারা প্রতীকায়িত করেছিল যা মূলত পার্থিব আধিপত্যের রূপক। পরবর্তী সুলতানরা যারা সিংহাসন গ্রহণ করেছিল তারা সবসময় “দ্যা রেড অ্যাপল” এর লক্ষ্য অনুসারে কাজ করেছিল।

অসাধারণ নেতা

ইস্তাম্বুলের বিজয় এই লক্ষ্যগুলির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সিরিজটিতে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) – এর বাণী ইতিহাসবিদ মাইকেল তালবট উদ্ধৃত করেছেন: “Le Tufte Hannel Kostantiniyye. Fele ni’mel emiru emiruha. Vele ni’mel ceyş, zâlikel ceyş” যার অনুবাদ: “অবশ্যই আপনারা, মুসলিম জাতি, কনস্ট্যান্টিনোপলকে জয় করবেন। এবং তার

সেনাপতি কত বিস্ময়কর হবে, জাতির সেনাপতি। এবং কত আশ্চর্যজনক, কত দুর্দান্ত হবে সেই সেনাবাহিনী, জাতির সেনাবাহিনী। “

সুলতান মেহমেদের সকল প্রেরণা তাঁর সেনাবাহিনীর মধ্যে আসে তারই প্রচারিত দৃঢ় নীতি থেকে।

নেটফ্লিক্স এই ডকুমেন্টারি সিরিজটি খুবই দক্ষ চিন্তিত শিরোনামের সাথে উপস্থাপন করেছে। শিরোনামটি দর্শকের মনে একটি প্রশ্ন নিয়ে আসে, “এটি কি এখন থেকে অন্যান্য সুলতানদের নিয়েই চলবে, না কি এটি অন্য সাম্রাজ্যের সাথে রূপান্তরিত হবে?” পরিচালকের সাথে এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, আসন্ন সিজন গুলির বিষয়বস্তু প্রচারিত হওয়া সিজনের জনপ্রিয়তা অনুসারে নির্ধারণ করা হবে।

কোনও না কোনও ভাবে সিরিজটি তুর্কির দর্শকদের দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে। এক পক্ষ এটিকে অটোমান বিরোধী প্রযোজনা হিসাবে বিবেচনা করে বলছে যে, সিরিজটিতে করা ঐতিহাসিক ভুলগুলি ইচ্ছাকৃত এবং বিদ্বেষপরায়ণ মনোভাব থেকে করা হয়েছে। অন্য পক্ষ তুর্কির চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাস ভিত্তিক প্রযোজনার ঘাটতি বিবেচনা করে যুক্তি দেয় যে, এটিকে প্রশংসা করা উচিত উভয় দিক দিয়েই। কারণ, প্রথমত এটি একটি বিশ্বব্যাপী প্রকল্প পাশাপাশি এটি ইতিহাসের প্রতিও আগ্রহ বাড়ায়।

আমি দ্বিতীয় পক্ষের সাথে একমত, যারা এই প্রকল্পটিকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে। আদতে তুরস্কে ইতিহাস সম্পর্কিত যথেষ্ট পরিমাণ প্রযোজনা নেই। ভাল বা খারাপ যাই হোক না কেন ইতিহাস নিয়ে আরও ভাল কাজ ও প্রযোজনা বের করে আনার জন্য কাউকে না কাউকে তো প্রথম পদক্ষেপটা নিতেই হবে। সিরিজটি দেখার সময় আমি অনেক দৃশ্যতে বিরতি নিয়েছি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নোট নেওয়ার জন্য। তারপরে আমি বাইজেন্টাইন ঐতিহাসিকদের কিছু বইও পড়েছি। যেমন: দুকাস, যিনি সেই সময়ে জীবিত ছিলেন। এছাড়াও তুরস্কের ইতিহাসবেত্তা টারসান বেগ, যিনি ব্যক্তিগতভাবে সেই বিজয়ে অংশ নিয়েছিলেন। আরও বিভিন্ন পাঠ্য ও দুকাসের উপাখ্যান দ্বারা বিবেচনা করলে বোঝা যায় যে, অসংখ্য কাহিনীর একটি ত্রিজগৎ সৃষ্টির মাধ্যমে সিরিজটি নির্মিত হয়েছে।

সংক্ষেপে, ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঘাটতি রয়েছে, পাশাপাশি অন্যান্য অনেক দিকও রয়েছে যা প্রশংসার যোগ্য। মূলত রেটিং নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং মূল বার্তা পৌঁছানোর বিষয়ে উদ্বেগের কারণে ভুলগুলো হয়েছে। এছাড়াও, এটি স্পষ্ট যে এই ডকুমেন্টারি সিরিজটি তুরস্কের দর্শকদের জন্য নয়, বরং নেটফ্লিক্সের ইউরোপীয়-আমেরিকান বাজারের বিশ্বব্যাপী দর্শকদের জন্য।

কনস্ট্যান্টাইনের ভুল

সিরিজের প্রথম পর্ব জুড়ে ছিল বিজয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং প্রস্তুতি শুরু করার ঘটনাগুলি। সম্রাট কনস্ট্যান্টাইন একটি ঐতিহাসিক ভুল করে বসেন এবং দাবি করেন যে, মেহমেদের চাচা ওরহানের জন্য দেওয়া শুল্ক আরও বাড়ানো হোক। এই হুমকি কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়, যা একটি বৈধতার নিমিত্তে যুদ্ধের দুয়ার খোলে। সিরিজটি এই দূতদের শিরশ্ছেদ দেখায়; তবে এটি রোমান বা তুরস্কের ইতিহাসে কখনো উল্লিখিত হয় নি। দূতদের না সেই সময়ে, না পুরো অটোমান ইতিহাসে হত্যা করা হয়েছিল। সর্বোপরি, এটি যুদ্ধের ইসলামী আইনের পরিপন্থী।

অসন্তোষজনক জবাবের পরে গ্র্যান্ড ডিউক লুকাস নটারাস সেই সম্রাটের ক্যাথলিক সাহায্যের বিরুদ্ধে তাঁর বিখ্যাত বচনটি বলেছিলেন, “শহরের মাঝখানে আমি লাতিন মাইটারের চেয়ে বরং একটি তুর্কি পাগড়ি দেখতে চাই” এটি বলার কারণ হলো ১২০৪ এর ক্যাথলিক ল্যাটিন আক্রমণ। এই আক্রমণটি নটারাস পুনরাহ্বান করতে পারত।

অটোমান সাম্রাজ্যের চান্দারলি হালিল পাশা এই বিজয়ের বিরোধিতা করেন এবং লুকাস নটারাসের সাথে দেখা করেন। উভয় পক্ষের বিশ্বাসঘাতকরা এই নামে কল্পিত হয়েছে। সুলতান মেহমেদ যখন এটি জানতে পারেন তখন মারা হাতুন তাকে শান্ত করে। যাইহোক, মারা হাতুনকে ১৪৫১ সালে সার্বিয়ায় প্রেরণ করা হয়েছিল। না চান্দারলি একজন বিশ্বাসঘাতক ছিলেন যিনি লুকাসের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন, না মারা হাতুন সুলতানের উপর তেমন প্রভাবশালী ছিলেন। এটি সম্পর্কে কোনও ঐতিহাসিক তথ্যই নেই এবং এটি কালানুক্রমের বিরোধী।

প্রকৌশল মেহমেদ কোথায়?

রুমেলিয়ান দূর্গের নির্মাণকার্য, সুলতান যেটাকে বোয়াজকেসেন দূর্গ নামে বলতেন, তা এই সিরিজে দেখানো হয়েছে। তবে, যে অসাধারণ প্রকৌশল দক্ষতার সাহায্যে মাত্র সাড়ে চার মাসের কম সময়ের মধ্যে এই দুর্গটি তৈরি হয়েছে তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয় নি।

১৪৫২-৫৩ এর শীতকাল ছিল এডিরনে তীব্র প্রস্তুতির সময়। অস্ত্রসস্ত্রের প্রকল্পগুলি কার্যকর করা হয়েছিল

যা বিশ্বের ইতিহাসে বিপ্লব ঘটাতে পারে। সিরিজটিতে ইস্তাম্বুল বিজয়ের জন্য কামান নিক্ষেপকারী ধাতু বিশারদ ও প্রকৌশলী উরবান এই পর্যায়ে উপস্থিত হন। উরবানকে সুলতানের কাছে একটি প্রকল্প উপস্থাপন করতে দেখানো হয়। তবে প্রকৃত ঘটনাটি ঠিক এর বিপরীত। সুলতান নিজেই কামানগুলোর নকশা করেছিলেন। তারা স্থপতি মুসলিহিদ্দিন এবং প্রকৌশলী সারুকা পাশার সাথে যৌথ পরিকল্পনা করে প্রকল্পগুলি নকশা করেছিলেন।

উরবান একাই সবচেয়ে বড় কামান তৈরি করে। অটোমান প্রকৌশলীরা অন্য সমস্ত কামান নিক্ষেপ করে। যখন উরবনের কামান গুলি চালাতে ব্যর্থ হয় তখনই অটোমান কামানগুলো সব দেয়াল ভেঙে দেয়। একটি বড় ত্রুটি হলো মুসলিহিদ্দিন এবং সারুকার মতো প্রকৌশলদের সিরিজে উল্লেখ করা হয়নি।

তেমনি, বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ব্যবহৃত কামানগুলি (Mortar) ছিল সুলতান মেহমেদের নিজস্ব নকশা। আমরা সিরিজটিতে চাকাযুক্ত বৃহৎ যে টাওয়ারগুলি দেখতে পাবো সেগুলিও সুলতানের নকশাকৃত। তবে এগুলি মোটেও ব্যবহৃত হয় নি, এগুলি কেবল সজ্জা। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই সমস্ত আশ্চর্যজনক কৌশলগুলি বোঝায় যে, সুলতান মেহমেদ একজন প্রতিভাবান প্রকৌশল। যাইহোক, সিরিজটির প্রথম দিকের পর্বগুলি এটিকে যথাযথভাবে চিত্রিত করতে পারে না; পরিবর্তে, আমাদের দৃষ্টিগোচরে পড়ে কেবল একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি। সুলতান মেহমেদের এই প্রতিভা বিকশিত হয়েছে শৈশব থেকে প্রাপ্ত সম্ভ্রান্ত ও যথাযথ শিক্ষা থেকে।

শিক্ষক ছাড়া শাহজাদা

 আক্রমণ শুরু হয় দ্বিতীয় পর্বে। দার্দানেলিস বন্দুক বা “গ্রেট তুর্কিশ বম্বার্ড” (ভারি কামান) থেকে গোলাবর্ষণ করে উরবান আঘাত হানতে থাকে। সুলতান লোভার্তভাবে কামানের গুলি চালানোর আদেশ দেন, যা যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। উরবান তাকে সরে যাওয়ার জন্য সতর্ক করে, তবে তিনি তার কথা অগ্রাহ্য করে তার দিকে উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং এটি বিস্ফোরিত হয়। এই বিস্ফোরণটি সত্য। উরবান এখানে মারা যায়। তবে সুলতান আহত হন নি। এই গল্পটি ফ্ল্যাশব্যাক সিকুয়েন্সের জন্য তৈরি।

দ্বিতীয় পর্বে আমরা শাহাজাদা মেহমেদকে দেখি। তার শৈশবের দৃশ্যগুলোতে সুস্পষ্ট ত্রুটি রয়েছে। তিনি মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকতেন, তাঁর মা বিদেশীনি ছিলেন এবং মারা ব্র্যাঙ্কোভিচ তার প্রতিপালন করেছিলেন এই ধারণাগুলি একেকটা উদ্ভট ভুল। সুলতান মেহমেদের মা ১৪৪৯ সালে মারা যান এবং তিনি যখন ‘সানজাক-বেগ’ ছিলেন তখন সর্বদা তাঁর মা’র সাথে ছিলেন। কারণ শাহজাদারা (সুলতানের ছেলে সন্তান) ‘সানজাক’ পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন তাদের মায়েদের তত্ত্বাবধানে।

শাহাজাদা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং চান্দারলি তাঁর শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত দৃশ্যগুলোতে এই কাজটি করেছিল যা সম্পূর্ণ কল্পকাহিনী। চন্দারলি সে সময়ে মহান উজির ছিলেন এবং রাজ্য কর্মকর্তারা শাহজাদার প্রশিক্ষণে জড়িত ছিলেন না। কেন মহান উজির এডিরনে সুলতানের সাথে থাকবেন শাহজাদাকে মনিসা শহরে শেখাতে? এই চাবুক ও বেতের আঘাত একটি অত্যন্ত অতিরঞ্জিত নাটক।

এটা সবার জানা যে, সুলতান তেমন বাধ্য ও সহজবশ্য ছিলেন না বরং আক্রমণাত্মক ও আবেগপ্রবণ একটি চরিত্র ছিলেন। তবে, এমন কোন শাস্তি ছিল না যেখানে শাহাজাদাকে তার অস্ত্র বা চাবুক ধরতে দেখা যায়। এছাড়াও, অটোমান ইতিহাসে এটি অকল্পনীয় যে, সুলতানি শাসনের প্রথম যুগে একজন জেনিসারি বাহিনীর আঘা সুলতানের দিকে এমনভাবে হেঁটে যাবে যেন সে তাকে মারতে যাচ্ছে এবং সেটিতে চান্দরলি তাকে বাধা দিবে।

আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, সুলতান মেহমেদের শিক্ষক এবং সেই যুগের বৈজ্ঞানিকদের স্ক্রিপ্টে যুক্ত করা হয় নি। সুলতানের ব্যক্তিগত গৃহশিক্ষক মোল্লা গুরানীর উপস্থিতি নেই এখানে, যিনি তাকে শাহাজাদা হওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। এছাড়াও আকসামসাদ্দিনের মতো বিখ্যাত চরিত্রটিও অনুপস্থিত। তিনিই ছিলেন শিক্ষক আকসামসাদ্দিন, যিনি বাস্তবে যুদ্ধের সবচেয়ে অনিশ্চিত দিনগুলিতে সুলতানকে উৎসাহিত করেছিলেন।

এমনকি ফ্রাঞ্জ বাবিঞ্জার, যিনি ‘মেহমেদ দ্য কনকুয়েরর’ সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক মতামত রেখেছিলেন, যুদ্ধে পন্ডিতদের প্রভাব প্রকাশ করে বলেছিলেন: “শেখ ও দরবেশরা সামরিক শিবির পরিদর্শন করেছিল এবং সৈন্যদের কাফেরদের রাজধানীর দেয়ালে ইসলামিক ব্যানার লাগাতে উৎসাহিত করেছিল, এবং তারা হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং আবু আইয়ুবের নাম উল্লেখ করতে থাকেন। আবু আইয়ুব নবীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যিনি ৬৭২ সালে কনস্টান্টিনোপলের আরবদের অবরোধের সময় সিটি গেটের সামনে মারা গিয়েছিলেন।”

সামরিক বাহিনীর এই মনোস্তত্ত্বটি সিরিজে কখনই প্রদর্শিত হয় নি। 

মারা হাতুন কে?

নেটফ্লিক্স দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য, মারা হাতুনকে নির্বাচিত এবং কল্পিত করা হয়েছিল। প্রথম পর্বে, আমরা দ্বিতীয় সুলতান মুরাদের মৃত্যুর পরে সিংহাসনে মেহমেদকে উত্তরসূরী হিসেবে দেখতে পাই। সুলতান মুরাদের সাথে কেবল মারা ব্র্যাঙ্কোভিচ দেখা গিয়েছে এবং তিনি উঠে দরজা বন্ধ করে দেন। যদিও শাহজাদা মেহমেদ চাবুকের শিকার হওয়ার পরে প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন, মারা হাতুন তাকে সান্ত্বনা দেন। যখন মেহমেদ এডিরনে পৌঁছায়, মারা তাকে সিংহাসন দেখিয়ে বলে, “এটি এখন আপনার।”

আমরা তাকে প্রতিটি পর্বে দেখতে পাই। তাকে মূলত ভবিষ্যদ্বাণী বলতে রাখা হয়েছে। বিজয় পশ্চাৎপদ হয়ে  গেলে তিনি আকসামসদ্দিনকে এর জায়গা প্রতিস্থাপন করেন। মারাকে এমন একজন হিসাবে দেখানো হয়েছে যাকে সার্বিয়া থেকে আনা হয়েছিল এবং তিনি সুলতানকে উৎসাহিত করেছিলেন।

প্রাসাদে শেষ মুহুর্তে সুলতান মুরাদের পাশে দাঁড়ানোর শেষ ব্যক্তি হলেন মারা হাতুন। সে সময় তিনি এডিরম প্রাসাদে ছিলেন বলে জানা যায়নি। সুলতান মুরাদ রাজনৈতিক কারণে মারাকে বিয়ে করেছিলেন। যখন মারা পৌঁছে ছিলেন, তখন মুরাদ তাকে বুর্সায় প্রেরণ করেছিলেন। কারণ তিনি চান নি বিবাহ অনুষ্ঠানটি হোক। তাঁর মৃত্যুকালে তাঁর সাথে অন্যান্য স্ত্রী ও কন্যা ছিল।

সুলতান মেহমেদ এবং মারা হাতুনের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক কখনও ছিল না, যেমনটা সিরিজে উপস্থাপন করা হয়েছে। সুলতান সিংহাসনে আরোহণের সাথে সাথেই তিনি তাকে সার্বিয়ান স্বৈরাচারবাদে প্রেরণ করেছিলেন এবং বিজয়ের পরে বেশ কয়েকবার তার সুযোগ নিয়েছিলেন।

কনস্ট্যান্টাইন নাকি জিউস্টিনিয়ানি?

ভাড়াটে জিউস্টিনিয়ানি এবং তার লোকরা বিজয়টিতে খুব সফল প্রতিরক্ষা প্রদর্শন করেছিল। ইতিহাসবিদরা এ বিষয়ে একমত। আসলে, যদি তিনি যুদ্ধ থেকে পালিয়ে না এসে সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের মতো লড়াই করে মারা যেতেন, তবে ইতিহাসে তাঁকে আরও ভাল করে স্মরণ করা হতো।

সিরিজের প্রথম পর্বগুলিতে, জিউস্টিনিয়ানিকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান থেকে আক্রমণ করতে দেখা যায়। সে হাজার হাজার জেনিসারি মেরে ফেলে। প্রথমত, জিউস্টিনিয়ানি অশ্বারোহীদের সাথে লড়াই করেন যারা যুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল। অশ্বারোহী বাহিনী ছিল সর্বাধিক জনবহুল ও প্রধান সেনাবাহিনী, যা অশ্বারোহী এবং পদাতিক বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত। জেনিসারি বাহিনী হলো সংখ্যালঘু। যাইহোক, ফিল্মে আমরা সচরাচর জেনিসারি বাহিনীকে অটোমান সেনাবাহিনী হিসাবে দেখি।

এখানে বলা হয় যে, জেনিসারি বাহিনী দাঙ্গা বা এলোপাতাড়ি আক্রমণে (melee) পারদর্শী নয়। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে ভুল। কারণ, জেনিসারি বাহিনী অল্প পরিসরে দুই বা ততোধিক বিরোধীদের মধ্যে সহিংস শারীরিক সংঘাত (close combat), হাতে-হাতে যুদ্ধ এবং বড় এলাকাব্যাপী (long range) যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদার সৈনিক ছিল। তারা সুলতান এবং প্রাসাদের ব্যক্তিগত সৈনিক। তারা যে কোনও অস্ত্র ব্যবহারে পারদর্শী। তন্মধ্যে তীরন্দাজরাও রয়েছেন। তারা রামদা এবং ইয়াতাগান ছুরির মতো অস্ত্রগুলি 

ব্যবহার করতো। তারা সেনাবাহিনীর সামনের লাইনে না গিয়ে আক্রমণ করে।

সিরিজের একটি বড় ঘাটতি হলো কার্যকর দূর্গ আরোহনের দৃশ্যের অভাব, যেখানে টাওয়ারগুলি ব্যবহার করা যেতে পারতো। এখানে সবসময় ক্লোজ শটে দৃশ্যগুলি ধারণ করা হয়েছে যার কারণে কয়েকটি পর্বের পরে দৃশ্যগুলি বিরক্তিকর হয়ে ওঠে।

তাদের কীভাবে দেখা উচিত?

পঞ্চম পর্বে, বিজয় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণীগুলিকে বিস্তৃত কভারেজ দেওয়া হয়েছে। স্পষ্টতই, পৌরাণিক কাহিনী বিজয়টি খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করে। এই পর্বে যা বর্ণিত হয়েছে তা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। গ্রীকদের পৌরাণিক কাহিনী এবং তুর্কিদের পৌরাণিক কাহিনী সম্পূর্ণ আলাদা।

গল্পটি কল্পিত হওয়ার সময় অন্যান্য প্রযুক্তিগুলিও অবহেলিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, হঠাৎ কুমারী মেরির মতো দেখতে একটি আলো হাজিয়া সোফিয়ার উপরে দৃশ্যমান হয় এবং শহর ছেড়ে যায়। জনগণ এবং অটোমান সেনাবাহিনী উভয়েই সুলতানের সাথে এটি দেখেন। এমন একটি স্থান যেখানে সুবিশাল দূর্গ রয়েছে সেখান থেকে এটি দেখা সম্ভব নয়। এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলি হলো কল্পকাহিনী যা পরামর্শদাতাদের দ্বারা প্রদত্ত তথ্যগুলিকে অতিসরল করে তোলে।

ইতিহাসবিদদের ভূমিকা

দ্বিতীয় মুরাদ ও দ্বিতীয় মেহমেদের যুগই অটোমান ঐতিহাসিকতার মোড় হয়ে দাঁড়িয়েছে যেহেতু প্রাচীন ঐতিহাসিকরা এই সময়কালে বেঁচে ছিলেন। তারা সকলেই দ্বিতীয় মুরাদের যুগের আগে সাধারণ এবং সংক্ষিপ্ত তথ্য দেওয়ার সময় তাদের নিজস্ব সময়কাল বিশদভাবে বর্ণনা করেন।

যে ইতিহাসবিদ দ্বিতীয় সুলতান মুরাদ এবং দ্বিতীয় মেহমেদ এর রাজত্বকালে বেঁচে ছিলেন তিনি হলেন দুকাস, যিনি ইস্তাম্বুল বিজয়ের সময় গ্রীক পক্ষে ছিলেন। দুকাস ১৪০০ থেকে ১৪৭০ এর মধ্যে জীবিত ছিলেন এবং বিজয়ের সময় সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের অধীনে ছিলেন। সাধারণত, তাঁর বইতে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা তুর্কীদের বিরোধী। যখন আমরা “রাইজ অফ এমপায়ারস: অটোমান” এর কল্পকাহিনীটি লক্ষ্য করি তখন আমরা দেখতে পাই এটি দুকাসের কাহিনির উপর নির্মিত।

অবাক করা বিষয় হলো, জালাল শেনগোর সিরিজটির অন্যতম তুর্কিশ উপদেষ্টা। তিনি ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ হিসাবে সমালোচিত হন। তবে, তিনি সর্বদা ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন, বিজয়ীর প্রশংসা প্রকাশ করার সময়। অন্য পরামর্শদাতাও কিছু কারণে সমালোচিত। এমরাহ সাফা গুরকান এর সমালোচিত হওয়ার মূল বিষয় হলো তার সামুদ্রিক ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন একাডেমিক কাজ। তবে, সিরিজের নৌযুদ্ধ সম্পর্কিত ক্ষেত্রগুলোতে তিনি খুব কম কথা বলার অনুমতি পেয়েছেন।

(পাঠকদের জ্ঞাতার্থে: লেখা এখনো সম্পাদনা প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। যেকোনো ধরণের ভুল থাকাটা স্বাভাবিক। সংবেদনশীল পাঠকদের নিজ দায়িত্ব বুঝে নেয়ার একান্ত অনুরোধ রইল)

Related Posts

Leave a comment