
কায়সেরি তুরস্কের অন্যতম বানিজ্যিক ও ঐতিহাসিক নগর। প্রাচীন সেলজুক ও উসমানীয় খেলাফতের অসংখ্য নিদর্শন নিয়ে দাড়িয়ে আছে এই শহর। রোমানদের শাসনামলে শহরটির নাম ছিল “মাজাকা”। পরবর্তীতে মুসলমানদের অধীনে আসায় শহরটির নামকরণ করা হয় “কায়সেরি”। ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে তুরস্কের মধ্যবর্তী প্রাচীন শহর কায়সেরি।
কায়সেরি প্রোভিন্সের অন্যতম জেলাগুলোর মধ্যে মেলিকগাজী, কোজাসিনান, তালাস, হাজিলার, ইন্জেসু, দেভেলী সহ রয়েছে আরো অনেকগুলো ছোট জেলা। সরকারি হিসেবে প্রোভিন্সটির জনসংখ্যা প্রায় ১২ লক্ষ। জনসংখ্যার বড় একটি অংশ মূল শহরেই বসবাস করে।
কায়সেরি শহরের অদূরে নগরীর স্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাউন্ট এরজিয়েস। ভূপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা প্রায় ৩৯১৬ মিটার ( ১২৮৪৮ ফুট)। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ভ্রমন করতে আসে এই পর্বতে।
কায়সেরি দর্শনার্থীদের জন্য আদর্শ একটি শহর। শহরের পরতে পরতে রয়েছে প্রাচীন ও প্রাকৃতিক অসংখ্য নিদর্শন ও স্থাপনা। তারই একটির নাম ‘কাপাদোকিয়া’। কায়সেরি প্রোভিন্সের অন্তর্গত নেভশেহিরে যার অবস্থান। সারা বছরেই সেখানে দর্শনার্থীদের আনাগোনা রয়েছে। এখানে পাবেন ভোরের সূর্যোদয়ের মনোরম দৃশ্য, ওপেন এয়ার মিউজিয়াম, এয়ার বেলুন। মাটির নীচে মনোরম শহরসহ আরো অনেক বিখ্যাত স্থাপনা। কায়সেরি শহরের কেন্দ্রে রয়েছে সেলজুক শাসনামলের অন্যতম নিদর্শন ‘কায়সেরি কেল্লা’, লাইব্রেরী, জাদুঘর ও পার্ক। রয়েছে বিখ্যাত জামান্তে নদী। এছাড়াও দর্শনার্থীদের দৃষ্টি কাড়ে কুলতেপে, আয়েরনাস, তালাস, দেভেলী-সহ শহরের বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত স্থান, সেলজুক ও উসমানী খেলাফতের প্রাচীন সব স্থাপনা।
শিক্ষাব্যবস্থার দিক থেকেও শহরটি এগিয়ে রয়েছে।উচ্চ শিক্ষার বিবেচনায় কায়সেরির পার্শ্ববর্তী শহরগুলো ছাড়াও মূল শহরের ভিতরে রয়েছে চারটি ইউনিভার্সিটি। যেগুলো ফলাফল এবং কার্যক্রমের ভিত্তিতেও দেশসেরা। ইউভার্সিটিগুলো হলো-
১. এরজিয়েস ইউনিভার্সিটি, ( ওয়ার্ল্ড রেঙ্কিং ৮৭৪)
২. আব্দুল্লাহগুল ইউনিভার্সিটি
৩. কায়সেরি ইউনিভার্সিটি
৪. নুহ নাজি ইয়াযগান ইউনিভার্সিটি
এরজিয়েস ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন ফ্যাকাল্টিগুলো বিভিন্নদিক বিবেচনায় রয়েছে দেশের শীর্ষ পর্যায়ে। এরজিয়েস তিব ( মেডিকেল) ফ্যাকাল্টির রয়েছে আলাদা অর্জন। দেশের শীর্ষ মেডিকেল অনুষদের একটি হলো এটি। ইসলামিক স্টাডিজ ও থিওলজি ফ্যাকাল্টিও এগিয়ে রয়েছে এক্ষেত্রে। ইউনিভার্সিটি রেঙ্কিং ছাড়াও ফ্যাকাল্টিগুলোর আলাদা অর্জনের জন্য সুনাম রয়েছে সারাদেশে। রয়েছে আধুনিক গবেষণা ও লেখারপড়ার সুযোগ-সুবিধা।
আব্দুল্লাহগুল ইউনিভার্সিটি কায়সেরির অন্যতম ইংরেজি মাধ্যম বিশ্ববিদ্যালয়। ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় সুনাম রয়েছে এটির।
কায়সেরি তুরস্কের অন্যতম বানিজ্যিক শহর হওয়ায় এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত। সড়ক পথে ইস্তাম্বুল হতে কায়সেরির দূরত্ব ৮০০ কি.মি। ৮/৯ ঘন্টার ভ্রমণের ভালোমানের বাহনে খরচ হবে
১২০ তার্কিশ লিরা, যার বর্তমান বাজারদরে বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৩৫০টাকা ( ১লিরা= ১১.৩২ টাকা)। সাধারণ পরিবহনে সেটা ৮০-৯০ লিরা হতে পারে। রাজধানী আংকারা থেকে দূরত্ব প্রায় ৩৫০ কি.মি এবং যাতায়াতে খরচ গুনতে হবে ভালোমানের বাহনে প্রায় ৫০ লিরা।
আকাশপথে ভ্রমনের জন্য রয়েছে ” কায়সেরি এরকিলেত এয়ারপোর্ট”। এক্ষেত্রে আপনাকে কায়সেরি হতে ইস্তাম্বুল পর্যন্ত বিশেষ অফার ছাড়া গুনতে হবে প্রায় ২৫০ তার্কিশ লিরা। সময় নিবে পুরো এক ঘন্টা।
অন্যান্য শহরগুলোর মতো কায়সেরিতেও বাসগুলোতে শহরের অভ্যন্তরীণ চলাচলে পাঞ্চ সিস্টেম চালু রয়েছে। সেক্ষেত্রে সাধারণ যাত্রীদের ক্ষেত্রে প্রতি পাঞ্চে খরচ হয় ৩.২০ লিরা এবং স্টুডেন্টদের বিশেষ কার্ডে খরচ হয় ১.৬০ লিরা। সেক্ষেত্রে বাসের গন্তব্যে দূরত্বের ভেদাভেদ ছাড়াই এই মূল্য প্রদান করতে হয়। এক্ষেত্রে বলা যায় যাতায়াত ব্যবস্থায় খরচের ব্যাপারটি ছাত্রবান্ধব।
তুরস্কের অন্যান্য শহরের মতো এ শহরেও রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্হায় ইন্সুইরেন্স পদ্ধতি চালু রয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ১০০০ লিরা খরচ করে মেডিকেল ইন্সুইরেন্সটি করতে হয়। সেক্ষেত্রে সরকারি হসপিটালগুলোতে আর কোনো খরচ করতে হয় না। এই সিস্টেমটি করা থাকলে ঔষধ ক্রয়ের ক্ষেত্রেও ৪০% খরচ ইন্সুরেন্স কর্তৃক বহন করা হয়। বেসরকারি হসপিটালগুলোতে সবখরচ প্রদান করতে হয়।
কায়সেরি শহরের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত। এখানে রয়েছে সরকারী সুবিশাল হসপিটাল- কায়সেরী সিটি হসপিটাল, সরকারী হসপিটাল, এরজিয়েস ইউনিভার্সিটির মেডিকেল সহ সরকারি- বেসরকারি আরো অনেকগুলো হসপিটাল।
জরুরী সেবায় সার্বক্ষণিক রয়েছে এম্বুল্যান্সের সুবিধা৷ ফোন পাওয়া মাত্রই এসে হাজির হবে। যারা সরকারি স্কলারশিপ নিয়ে এদেশে আসবে তাদের, এই সম্পর্কে আলাদা করে ভাবার কিছু নেই। উপর্যুক্ত সুবিধাগুলো তাদের জন্য প্রযোজ্য। উপরোন্তু ইন্সুইরেন্স খরচও স্কলারশিপ প্রদানকৃত সংস্থা বহন করবে।
সরকারি স্কলারশিপপ্রাপ্তদের রয়েছে সরকার কর্তৃক ডরমিটরির সুব্যবস্থা। কিন্তু কেউ যদি আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে চায়, তাহলে তারা সেক্ষেত্রে বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে ছয় মাসের এডভান্স টাকা পরিশোধ করে ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে পারবে। কাঠামোগত দিক থেকে বাসাগুলো একইরকম হলেও শহরের সেন্টারপ্লেসে যে বাসাটির ভাড়া ১৫০০ লিরা, দূরত্বভেদে ভাড়ার পরিমাণ কমে ৭০০-৮০০ লিরায় আসতে পারে। এটা স্থানীয় অধবা ভিনদেশী, সকলের জন্য প্রযোজ্য। ইউনিভার্সিটি থেকে ক্ষেত্রবিশেষে পিএইচডি হোল্ডারদের জন্য তুলনামূলক কম খরচে কোয়ার্টারের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। অন্যান্য শহরের চেয়ে জনসংখ্যা কম হওয়াতে এখানকার পরিবেশও অনেক সুন্দর এবং বসবাসের উপযোগী একটি শহর কায়সেরি।
কায়সেরিতে অন্যান্য শহরের চেয়ে জীবনমান উন্নত হলেও খরচ তুলনামূলক অনেক কম। বাসাভাড়া ব্যতীত ৬০০ লিরার ভিতরে একটি পরিবারের স্বাভাবিক খাওয়ার খরচ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে কয়েকজন ছাত্র মিলে একটি ফ্ল্যাট নিয়ে একসাথে খেলে, একজনের জন্য খরচটা অনেকাংশেই কমে যাবে।
তুরস্কের শীতপ্রধান অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম একটি শহর কায়সেরি। তবে হাড়কাঁপানো শীত পাবেন বছরে তিন মাস। লোকমুখে প্রচলিত আছে, “কায়সেরিনিন গুনেশি ইয়ালান্জিদির” অর্থাৎ কায়সেরির সূর্য মিথ্যুক। কেননা একই দিনে এখানে কয়েকধরণের আবহাওয়ার মুখোমুখি হবেন।বাহিরে প্রখররোদ দেখে জ্যাকেট ছাড়া বের হবেন, পথিমধ্যে তুষারপাত আপনাকে ঘিরে নিবে। কনকনে শীতে ভূগে এইধরণের ভুল না করার প্রতিজ্ঞা করবেন। অন্যদিন পুরোটা সময়ে ভারী জ্যাকেটটি কাঁধে নিয়ে ঘুরবেন কিন্তু গায়ে দেয়ার ফুরসত পাবেন না। অবশ্য এমন আবহাওয়া পাওয়া যাবে তিন-চারমাস, বাকি সময়টা নাতিশীতোষ্ণ। তবে এক কাপ কফি নিয়ে শীতকালের ঝিরিঝিরি বরফের খেলাটি কিন্তু দেখতে মন্দ নয়।
সবমিলিয়ে ‘কায়সেরি’ বসবাসের জন্য আদর্শ একটি শহর।
(পাঠকদের জ্ঞাতার্থে: লেখা এখনো সম্পাদনা প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। যেকোনো ধরণের ভুল থাকাটা স্বাভাবিক। সংবেদনশীল পাঠকদের নিজ দায়িত্ব বুঝে নেয়ার একান্ত অনুরোধ রইল)